বাংলাদেশের অপরাধ জগতের এক সময়ের শীর্ষ নাম সুব্রত বাইন দীর্ঘদিন ধরেই ছিলেন আলোচনার কেন্দ্রে। সম্প্রতি তার গ্রেফতারের পর ফের সামনে এসেছে এক বিস্ময়কর তথ্য—তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এমআই’-এর হয়ে কাজ করতেন।
এই চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এনেছেন লন্ডনে অবস্থানরত আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের। বৃহস্পতিবার রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া একটি পোস্টে তিনি সুব্রত বাইন এবং তার সহযোগী মোল্লা মাসুদ সম্পর্কে বিস্তর তথ্য তুলে ধরেন।
শুরুটা ছিল সন্ত্রাসী তালিকার শীর্ষে স্থান নিয়ে
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর তালিকা তৈরি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তালিকার শীর্ষে ছিলেন সুব্রত বাইন, যার মাথার দাম ধরা হয়েছিল এক লাখ টাকা।
পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়লে সুব্রত তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী মোল্লা মাসুদকে নিয়ে যশোর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যান। তবে চাঁদাবাজির জন্য তিনি গোপনে বেনাপোল দিয়ে দেশে আসতেন এবং যশোরের বেজপাড়ায় বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবারের সদস্যদেরও সেখানে রাখতেন।
ভারতে গোয়েন্দাদের নজরে, শুরু গোয়েন্দা মিশনের
কিছুদিন পর কলকাতা পুলিশ সুব্রতকে গ্রেফতার করলেও তাকে ছাড়িয়ে আনেন শীর্ষ সন্ত্রাসী তানভিরুল ইসলাম জয়, যিনি ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এরপর কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার এস কে চক্রবর্তীর আহ্বানে সুব্রত, মাসুদ ও জয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হন।
তাদের দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশে কমান্ডো ট্রেনিং। পরে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে দেওয়া হয় একাধিক মিশনের দায়িত্ব। বাংলাদেশে অবস্থানরত উলফা ও নাগাল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের নেতাদের চিহ্নিত করে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঢাকায় গোপন হত্যা মিশন ও মোস্তাকিম হত্যাকাণ্ড
২০০৩ সালে সুব্রত ঢাকায় ফিরে মোহাম্মদপুরে হামলা চালিয়ে এক বম নেতার স্ত্রী ও শিশুসন্তানকে হত্যা করেন। এরপর গুলি করে হত্যা করেন মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের মোস্তাকিম কাবাবের মালিক মোস্তাকিমকে, যিনি নাকি পাকিস্তানি সংযোগের কারণে ভারতীয় গোয়েন্দাদের টার্গেটে ছিলেন।
এছাড়া তিনি একাধিকবার উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়ার উপর হামলার চেষ্টা করেন।
পাসপোর্ট জালিয়াতি ও গোপন অবস্থান
২০০৭ সালে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সহায়তায় ‘আলী মোহাম্মদ’ নামে ভারতীয় পাসপোর্টে চীন পালিয়ে যান সুব্রত। পরে সেখান থেকে যান দুবাই, যেখানে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা তার জন্য বিলাসবহুল ভিলায় থাকার ব্যবস্থা করে। মোল্লা মাসুদও সেখানে যোগ দেন।
দাউদ ইব্রাহিমের চক্রে প্রবেশের জন্য টাইগার মেমনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে বলা হয় তাদের, যদিও এই মিশন সফল হয়নি।
শেষমেশ গ্রেফতার এবং র্যাবের হেফাজতে নতুন মিশন
পরবর্তীতে নেপাল হয়ে ভারতে প্রবেশের পর পরিকল্পনামাফিক কলকাতা পুলিশ STF তাকে গ্রেফতার করে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুব্রতকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তে হস্তান্তর করা হয় র্যাবের কাছে। র্যাব সদর দপ্তরে তার সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও জিয়াউল আহসানসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।
তাকে লন্ডনে একটি ‘টার্গেট’ হত্যা মিশনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। সফল হলে পরিবারসহ কানাডায় পাঠানোর আশ্বাস দেওয়া হয়। তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় স্নাইপার রাইফেলের ব্যবহার, দূরবর্তী টার্গেট নির্ধারণ, আবহাওয়ার প্রভাব বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর।
সরকার পতনের পর পাল্টে যায় সব পরিকল্পনা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সুব্রতকে তার মেয়ে বিথির জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয় এবং নতুন নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করতে বলা হয়। এরপর থেকেই সে আবারও প্রকাশ্যে আসা শুরু করে ও ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন করে।
ফের সহযোগী মোল্লা মাসুদকে বাংলাদেশে পাঠানো হয় স্যাটেলাইট ফোনসহ। সুব্রত, মাসুদ ও আরেক পলাতক সন্ত্রাসী লেদার লিটনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পলাতক নেতারা যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে দাবি করা হয় সেই পোস্টে।
দ্রষ্টব্য: এই প্রতিবেদনটি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। উল্লিখিত কোনো তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
যশোর টাইমস/এআই