যশোরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে রডের বদলে বাঁশের চটা ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের অভিযোগ, রমজানের ছুটির সুযোগে বাঁশের চটা ও নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়েছে তিনতলা ভবনের কাঠামো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আকস্মিক অভিযান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেলেও ষড়যন্ত্রের দাবি করেছেন ঠিকাদার ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) কর্মকর্তা।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খলশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন তিনতলা ভবনটি বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর। আপাত দৃষ্টিতে শক্তিশালী কাঠামো মনে হলেও এ ভবন নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারের পাশাপাশি রডের বদলে বাঁশের চটা, কাঠ ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে রয়েছে ছাদ ঢালাইয়ে আস্ত ইট ব্যবহারের। যা অনেকটা দৃশ্যমান।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের অভিযোগ, নির্মাণ কাজের শুরু থেকে তদারকি করতে চাইলেও ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ার করতে দেয়নি। এমনকি রমজানের ছুটির সুযোগ কাজে লাগিয়ে তড়িঘড়ি তিনতলার মূল কাঠামো নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু ঢালাই চলাকালে বিদ্যালয় কমিটির এক সদস্য বাঁশের চটা ব্যবহারের বিষয়টি দেখে ফেলায় বন্ধ করা হয় কাজ।
তাদের দাবি, এমন ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তাই ভবনটি পুনর্নির্মাণের দাবি তাদের। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোহেলী খাতুন বলেন, বিদ্যালয়ের ঢালাইয়ের কাজ চলা অবস্থায় চটা ব্যবহার করা হয়েছে। ওইদিন বিদ্যালয় বন্ধ ছিল। আমরা ঠিকাদারকে একজন পর্যবেক্ষক দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ঠিকাদার তা মানেননি। অনিয়ম ধরার পড়ার পর দুদকে অভিযোগ দিলে দুদকের কর্মকর্তারা আসেন। আমরা তাদের জানাই ঠিকাদার ও ইঞ্জিনিয়ার তাদের ইচ্ছামতো কাজ করেছে। বন্ধের ভিতরে অতি দ্রুত তিনতলা ভবন নির্মাণের কাজ শেষ করেছে। এরপর প্রাথমিক তদন্তের দুদক বাঁশের চটা ব্যবহারের প্রমাণ পান।
প্রধান শিক্ষিকা বলেন, আমাদের বিদ্যালয়ের কাজ সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে আমি কোনো ঝুঁকি নিতে পারবো না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একজন সদস্য প্রথম বাঁশের চটা ব্যবহার করতে দেখেন। তখন স্থানীয়সহ বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি জানানো হয়। এরপর কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। রমজানের ছুটির মধ্যে দ্রুত গতিতে তিনতলা ভবনের সকল ঢালাই কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যে ধরনের ও যে পরিমাণ রড ব্যবহারের কথা তা করা হয়নি। নিম্নমানের সিমেন্ট, বালু ও খোয়া ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া বাঁশের চটার ব্যবহার সবাই প্রত্যক্ষ করেছে। ভবনের মূল স্ট্রাকচারের বাঁশের চটা ব্যবহার করা হয়েছে কী না তা যাচাই প্রয়োজন। দুর্বল অবকাঠামোর ভবন সন্তানদের ঝুঁকি নিয়ে পাঠাব না।
এদিকে অভিযোগে পেয়ে গত ২৯ এপ্রিল প্রাথমিক তদন্ত অভিযানে রডের বদলে বাঁশের চটা ব্যবহারের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এ বিষয়ে দুদক যশোরের উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, স্থানীয়দের কাছ থেকে খলশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণে রড কম দিয়ে বাঁশের চটা ব্যবহারের অভিযোগ পাই। এরপর ২৯ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. আল আমীনের নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি দল নির্মাণাধীন ওই ভবনে অভিযান চালানো হয়। তারা একজন বিশেষজ্ঞকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। তারা নির্মাণাধীন ভবনে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহারের প্রাথমিক সত্যতা পান। এছাড়া ভবন নির্মাণে আরও অনিয়ম ধরা পড়েছে।
তিনি বলেন, দুদক টিম ও প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ টিমের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক তদন্ত করা হবে এবং দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অবশ্য পুরো অভিযোগটি ষড়যন্ত্রের অংশ বলে দাবি করেছেন ঠিকাদার ও এলজিইডির কর্মকর্তা। ঠিকাদার ইকবাল হোসেন নয়ন বলেন, কাজটি আমার না। আপনি বিশ্বজিৎ কনস্ট্রাকশনের মালিক বিশ্বজিৎ কুমার রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিশ্বজিৎ দাদার লাইসেন্স ব্যবহার করে বাঘারপাড়ার শামসুর রহমান দরপত্র দাখিল করেন। কাজটি বিশ্বজিৎ কনস্ট্রাকশন পায়। এরপর শামসুর রহমান কাজটি ৬ লাখ টাকায় আমার কাছে বিক্রি করে দেয়।
তিনি বলেন, ভবন নির্মাণে কোনো অনিয়ম হয়নি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। আমার অনুপস্থিতিতে মিস্ত্রি জানালার কাজে বাঁশের চটা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু স্থানীয়দের বাধায় সেটি পারেনি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার ও এলজিইডি কর্তৃপক্ষ বিষয়টি যাচাই করে কোনো অনিয়ম পাননি।
এলজিইডির বাঘারপাড়া উপজেলা প্রকৌশলী আবু সুফিয়ান বলেন, ঠিকাদার না জানিয়ে জানালার সঙ্গে সেলফ ঢালাই দেয়ায় আমি তা বন্ধের জন্য চিঠি ইস্যু করি। এরপর সে ঢালাই ভাঙতে গেলে স্থানীয় দুই ব্যক্তি তাতে বাধা দেয়। এরপর তাদের বাধা উপেক্ষা করে সেলফ ভেঙে দেয়া হয়। কিন্তু সেখানে বাঁশের চটা পাওয়া যায়নি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা অফিসের টিমের সামনে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর করেও বাঁশের চটা পাওয়া যায়নি।
তিনি আরও বলেন, দুদকের অভিযানের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে তারাও বাঁশের কোনো চটা পায়নি। মূলত স্থানীয় দুই ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এলজিইডির তথ্য মতে, ২০২১ সালে অনুমোদন পাওয়া ৪তলা ফাউন্ডেশনে তিনতলা ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪২ হাজার ৪৩১ টাকা। জমি নির্ধারণসহ নানা জটিলতায় এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে।
///সময় সংবাদ///
Leave a Reply